সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে নববিবাহিতা তরুণীকে গণধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৮ আসামির সবাই দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। সর্বশেষ রবিবার পাঁচদিনের রিমান্ড শেষে অভিযুক্ত তারেক অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াদুর রহমানের আদালতে এবং মাহফুজ মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক সাইফুর রহমানের আদালতে জবানবন্দি দেন। এর আগে এজাহারভুক্ত ছয় আসামিসহ মোট ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে পাঁচদিন করে রিমান্ডে নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ইতোমধ্যে সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, অর্জুন লস্কর, রবিউল, রাজন আহমদ ও আইনুদ্দিন আইনুলকে রিমান্ড শেষে আদালতে হাজির করা হলে তারা ধর্ষণের দায় স্বীকার করে নিয়ে জবানবন্দি দেন।
দু দফায় ধর্ষিত হন তরুণী : পুলিশ, আদালত ও অন্যান্য সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়ার আগে এমসি কলেজের পাশেই রাজপাড়া এলাকার পাঁচতলা ভবনের একটি ফ্ল্যাটে ধর্ষণের শিকার হন ওই তরুণী। ফ্ল্যাটটি ধর্ষণে অভিযুক্ত অর্জুনের নামে ভাড়া নেওয়া বলে জানা গেছে। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় ছেলেবন্ধু আইনুলের ওপর ভরসা করে সেই ফ্ল্যাটে দেখা করতে এসেছিলেন ওই তরুণী। বিষয়টি এজাহারেও উল্লেখ করেন নির্যাতিতার স্বামী। তিনি জানান, আইনুল নামে এক ছেলেবন্ধু তার স্ত্রীকে কল দেওয়ার পর তার সঙ্গে দেখা করবেন বলে গাড়ি থেকে নামেন তার স্ত্রী।
আইনুলের সঙ্গে তরুণীর দেখা করতে যাবার বিষয়টি অভিযুক্তদের সবাই জানতেন। ফ্ল্যাটটি অর্জুনের হলেও কৌশলে সেখানে অবস্থান করছিলেন তারেক ও রাজন।
একাধিক সূত্র জানায়, আইনুলের সঙ্গে দেখা করতে গেলে সেখানে কৌশলে তারেক, রাজন ও আইনুল ধর্ষণ করেন তরুণীকে। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায় এমসি কলেজ গেটে গাড়িসহ অপেক্ষারত স্বামীর কাছে যেতে চাইলে তাকে ছেড়ে দেন তারা। কিন্তু এমসি কলেজ গেটে এসে গাড়িতে ওঠতে চাইলে পরস্পর যোগসাজশে এই দম্পতিকে আটকান সাইফুর, অর্জুন ও রনি। তরুণীর চরিত্র হনন ও স্বামীকে ভয় দেখিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে। গাড়ির ড্রাইভিং সিট থেকে তরুণীর স্বামীকে নামিয়ে সেখানে চড়ে বসেন তারেক।
করোনার কারণে বন্ধ বিশাল ছাত্রাবাসে সাইফুর রহমানের একক আধিপত্য থাকায় এই জায়গাটিকে নিরাপদ মনে করে অপরাধীরা। তরুণীকে নিয়ে অর্জুন, সাইফুর, রনি ও তারেক ছাত্রাবাসের নবনির্মিতব্য পাঁচতলা ভবনের পাশে নির্জন স্থানে গাড়ি থামায়। সেখানে মোটরসাইকেলে এসে যোগ দেন রবিউল ও মাহফুজ। স্বামীকে একপাশে আটকে রেখে তরুণীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন তারা। টাকা, অলংকার ও মোবাইলও ছিনিয়ে নেন। এ সময় পাঁচতলা ছাত্রাবাসের দুতলায় থাকা এক শিক্ষার্থী বেরিয়ে এলে তাকে ধমক দিয়ে ভেতরে যাবার হুকুম দেন ধর্ষকরা।
ধর্ষণ শেষে গাড়ি আটকে রেখে ঘটনা কাউকে না জানিয়ে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে এসে গাড়ি ফেরত নেবার কথা বলে ছেড়ে দেওয়া হয় স্বামী ও স্ত্রীকে।
ছাত্রাবাস থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় পেয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বাবলা চৌধুরীকে বিষয়টি জানান নির্যাতিতার স্বামী। এ সময় পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করা হলে শাহপরান থানার সহকারী কমিশনার ও ওসি ছাত্রাবাসের গেটে উপস্থিত হয়ে ছাত্রাবাসে প্রবেশে কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রার্থনা করেন। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে গাড়িতে থাকা ধর্ষণের আলামত নষ্ট করার চেষ্টা চালায় অপরাধীরা। তবে তার আগেই সেখানে উপস্থিত হন শাহপরান থানার এসআই সোহেল রানা ও বাবলা চৌধুরী। এ সময় আসামিরা পালিয়ে গেলে গাড়ি ও অন্যান্য আলামত উদ্ধার করে পুলিশ। রাতে অভিযান চালিয়ে সাইফুর রহমানের দখল করে রাখা কক্ষ থেকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
প্রসঙ্গত, গত ২৫ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) সন্ধ্যারাতে নবদম্পতিকে তুলে নিয়ে স্বামীকে আটকে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে নিয়ে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে ছাত্রলীগের একদল কর্মী। এ ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। বেরিয়ে আসে ছাত্রলীগের নাম নিয়ে ছাত্রাবাসে অস্ত্র, মাদক, জুয়া ও নারী কেলেঙ্কারির মতো তৎপরতা চালানোর বীভৎস চিত্র।
Leave a Reply